খালিদ সাইফুল, কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় এবছর উচ্চ মাধ্যমিকে গড় পাশের হারে সংখ্যাগত সন্তুষ্টি থাকলেও কাঙ্খিত মানসম্মত ফলাফলে ঘটেছে ব্যাপক বিপর্যয়। তবে এবছরের ফলাফল ভিত্তিক সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুষ্টিয়া আবারও শীর্ষস্থানে নিজ অবস্থানকে অক্ষুন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ।
কুষ্টিয়া শহর কেন্দ্রিক ১ম সারির ১০টি কলেজের গড় পাশের হারে সংখ্যাগত অবস্থান অধিক হলেও উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কাঙ্খিত যে স্কোর বা গ্রেড পয়েন্ট প্রয়োজন সেক্ষেত্রে শতকরা হারে রয়েছে দৈন্যতার তলনীতে।
কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের শিক্ষা ও আইসিটি বিভাগের তথ্যমতে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা-২০২৩ এ জেলার ৬৯টি কলেজ থেকে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে মোট ১৪ হাজার ৭৬জন পরীক্ষার্থী ২২টি কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশ গ্রহন করে। এসব পরীক্ষার্থীদের মধ্যে ৬ হাজার ৬শ ৪৫ জন ছাত্র এবং ৭হাজার ৩শ ৩১জন ছিলো ছাত্রী। ২৬ নভেম্বর প্রকাশিত উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা-২০২৩র ফলাফলে দেখা যায় উত্তীর্ন বা পাস করা শিক্ষার্থীদের মোট সংখ্যা ৯ হাজার ৭০জন যার মধ্যে ৩ হাজার ৮শ ৭০জন ছাত্র এবং ৫ হাজার ২শ জন ছাত্রী। জেলায় অংশ গ্রহনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে গড় পাশের হার ৬৪ দশমিক ৪৪ ভাগ। যেখানে সংশ্লিষ্ট যশোর শিক্ষাবোর্ডে এছর গড় পাশের হার ছিলো ৬৯ দশমিক ৮৮ ভাগ এবং এই শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ২০২৩ এ সর্বোচ্চ পাশের হারে শীর্ষে রয়েছে খুলনা জেলা পাশের হার ৮০ দশমিক শুন্য ৪ ভাগ।
এবছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা-২০২৩ এর ফলাফলে জেলার শীর্ষ বা প্রথম সারির ৫টি কলেজ থেকে উত্তীর্ন শিক্ষার্থীদের তুলনা মূলক চিত্রে দেখা যায়, কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে বিজ্ঞান-৪’শ ৬৯, মানবিক-২’শ৮৪ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৩’শ৯৯সহ পরীক্ষায় অংশ নেয়া মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ হাজার ১শ ৫২জন। উত্তীর্ণ হয়েছে ১হাজার ১শ ১৩জন এবং বাকী ৩৯জন অকৃতকার্য হয়েছে। এদের মধ্যে জিপিএ ৫ পেয়েছে ৫শ ২৭জন যার মধ্যে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে জিপিএ ৫ প্রাপ্ত সংখ্যা ৩শ ৭৬জন, মানবিক থেকে ১’শ ৬জন এবং ব্যবসায় শিক্ষা থেকে ৪৫ জন। সরকারী মহিলা কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়া বিজ্ঞান বিভাগ- ৩শ ৪০, মানবিক ৩শ ২৪ ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ২শ ৭৮জনসহ মোট ৯’শ ৪২জন। উত্তীর্ন হয়েছে ৮’শ ৯৬জন। গড় পাশের হার প্রায় ৯৫ শতাংশ হলেও জিপিএ ৫ প্রাপ্তের সংখ্যা যথাক্রমে বিজ্ঞান বিভাগে- ৬৯, মানবিকে ৩৯ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ২জনসহ মোট জিপিও প্রাপ্তের সংখ্যা ১’শ ১০জন। সরকারী সেন্ট্রাল কলেজ থেকে পরীক্ষায় অংশ নেয়া বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ২’শ ৬১, মানবিক- ২শ ১১ এবং ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ থেকে ৮৬জনসহ মোট ৭’শ ৩জন শিক্ষার্থীর মধ্যে উত্তীর্ন হয়েছে ৬’শ ৫৮জন। এদের মধ্যে জিপিএ ৫ প্রাপ্তের সংখ্যা যথাক্রমে বিজ্ঞান- ১২৩, মানবিক- ২৬ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় ১জনসহ মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে ১’শ ৫০জন শিক্ষার্থী।
একই ভাবে কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ তেকে অংশ নেয়া মোট ৮’শ ৬৪জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছে ৫’শ ৬১জন। এদের মধ্যে কেবলমাত্র বিজ্ঞান বিভাগের ২শ ৮জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৪জন জিপিএ ৫ পেলেও মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের কেউ জিপিএ-৫ পায়নি। সামগ্রীক চিত্রের ভিত্তিতে এবছরের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে গড় পাশের হার অধিক দেখালেও গড় মান সম্মত ফলাফলের হার চরম ভাবে হতাশা ব্যঞ্জক মনে করছেন জেলার শিক্ষাবিদগন।
জেলার বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের দৈন্যতা বিষয়ে কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের পদার্থ বিজ্ঞান ভিাগের সহকারী অধ্যাপক লাল মোহাম্মদ বলেন, ‘উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর বিজ্ঞান শিক্ষার্থী হিসেবে মাধ্যমিক পর্যায় হতে যে মানদন্ডের শিক্ষাটা অর্জন করে আসার কথা সেখানে শিক্ষার্থীদের মানদন্ডটা একেবারে তলানীতে। যে কারণে সিলেবাস ও কারিকুলাম অনুসরন করতে গিয়ে কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষকরা যেখান থেকে পাঠাদান শুরু করছেন সেই মানদন্ড থেকে শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহন করতে না পারায় শ্রেণীকক্ষের প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ছুটছে কোচিং সেন্টারে। এতে শিক্ষার্থীরা না জেনেই বা না বুঝেই তাদের বিজ্ঞান শিক্ষার ১২টা বাজিয়ে ছাড়ছে।
সরকারী মহিলা কলেজের ইংরেজী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অজয় কুমার মৈত্র বলেন, ‘কলেজ শ্রেনীকক্ষের পাঠ গ্রহন থেকে শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হয়ে ছুটে যাচ্ছে কোন বড় ভাই’য়ের কাছে বা কোচিং সেন্টারে, এর মূল কারন হলো- একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের নির্ধারিত ইংরাজি পাঠ্য বই থেকে শিক্ষক যখন পাঠদান শুরু করছেন, সেটা অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই রিসিভ করতে পারছেনা। এই শ্রেনির পাঠ্যবই ও কারিকুলামে এসব শিক্ষার্থীদের নতুন করে প্রাইমারি ও মাধ্যমিক স্কুল পর্যায়ের গ্রামার শেখানোর সুযোগ নেই’। যে কারনে কলেজের একজন ইংরেজী শিক্ষক যতই ভালো হোন না কেনো শিক্ষার্থীরা তার প্রতি আকর্ষন বোধ করছে না’।
কুষ্টিয়া সরকারী মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. মো: আমিনুল হক অভিমত দেন, ‘প্রাতষ্ঠানিক শিক্ষার গোড়াপত্তনটা মজবুতিকরনের কোন বিকল্প নেই। আমাদের শিক্ষকরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেন শিক্ষার্থীদের মানসম্মত পাঠদান করতে। অথচ শিক্ষার্থীরা কলেজে শেনীকক্ষের পাঠ গ্রহন না করে ছুটছে কোচিং সেন্টারে। বিপর্যয়টা ঘটছে এখানে। যেখানে দেশসেরা উচ্চ শিক্ষিতরা একটা মানদন্ডের ভিত্তিতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে কলেজ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। শেনীকক্ষে পাঠদান বিষয়ে রীতিমতো নানা প্রশিক্ষন ও কোর্স সম্মন্ন করে প্রত্যেক শিক্ষকই সঠিক পাঠদানে সক্ষমতা অর্জন করেন। অথচ এসব শিক্ষকদের ক্লাস বর্জন করে কার্যত: নিজেদের মানসম্মত শিক্ষাকেই বর্জন করে চলেছে শিক্ষার্থীরা।এর উত্তোরনে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবসহ সংশ্লিষ্ট সকলের দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কারসহ সঠিক ও সমন্বিত উদ্যোগটা নেয়া এখন সময়ের দাবি হয়ে গেছে।
কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শিশির কুমার রায় বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠান থেকে এবছর যারা উচ্চ মাধ্যমিকে পাশ করেছে, তাদের মধ্যে ৮০% ভাগই ভর্তির সময় এসএসসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া পূর্ব যোগ্যতার ভিত্তিতেই ভর্তি হয়েছিলো। অথচ প্রকাশিত ফলাফলে তাদের মধ্যে ৫৫% ভাগই জিপিএ ৫ অর্জনের যোগ্যতা থেকে ঝরে গেলো। একজন শিক্ষক হিসেবে এটা অবশ্যই আমাকে ব্যাথিত করে বৈকি’।
এবার যারা জিপিএ ৫ নিয়ে উত্তীর্ন হয়েছে তারা আবার মানসম্মত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি যুদ্ধে অংশ নিয়ে একটা অংশ ঝড়ে যাবে, তাহলে সামগ্রীক বিবেচনায় বলা যায় মানসম্মত শিক্ষা পাওয়া থেকে এসব শিক্ষার্থীদের গড়ে উঠার গড় হার দৈন্যতার তলানীতে ঠেকেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই’। এমন পরিস্থিতির উত্তোরণে শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনসহ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহন ব্যতীত বিকল্প কোন পথ নেই। নচেৎ সরকার শিক্ষাখাতে যে বিপুল অর্থব্যয়ে নানা কর্মযজ্ঞ চালাচ্ছে তার প্রত্যাশিত ফলাফল গিয়ে দাঁড়াচ্ছে দৈন্যতার তলানীতে’।