আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি: আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজেদের প্রার্থীতার জানান দিচ্ছেন সুনামগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশীরা। সুনামগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক প্রার্থী সক্রিয় হয়েছেন সুনামগঞ্জ- ১ (জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা, তাহিরপুর ও মধ্যনগর) আসনে। এলাকার বিভিন্ন হাট বাজারে গণসংযোগ, শান্তি সমাবেশ আয়োজনসহ আকর্ষণীয় স্থানগুলোতে দৃষ্টি নন্দন পোস্টার, ব্যানার, ফেস্টুন লাগাচ্ছেন প্রার্থী সমর্থকদের কর্মীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও সরব প্রার্থী ও তাদের কর্মী সমর্থকরা। পোস্টার ছড়িয়ে এবং আওয়ামীলীগ সরকারের উন্নয়ন সম্বলিত লিফলেট বিতরণ করে নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের দৃষ্টি কাড়ার চেষ্টা করছেন সবাই।
সুনামগঞ্জ-১ (জামালগঞ্জ-ধর্মপাশা-তাহিরপুর ও মধ্যনগর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন। হঠাৎ করে ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হবার পর থেকেই নানান ইস্যুতে আলোচিত-সমালোচিত তিনি। দলীয় মনোনয়নে তিন তিনবার এমপি হয়েছেন তিনি। লাগাতার তিনবারের সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন নানান অনিয়ম-দুর্নীতিতে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দু থাকার কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যাও বেড়েছে বলে অভিমত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের। সুনামগঞ্জ-১ আসনে এ পর্যন্ত ৯ জন প্রার্থী তাদের প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছেন। তারা হলেন সুনামগঞ্জ-সিলেট সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. শামীমা আক্তার খানম, তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল, জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি এবং সুনামগঞ্জ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সাবেক ছাত্রনেতা সেলিম আহমদ, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. রঞ্জিত সরকার, সাবেক যুগ্ম-সচিব বিনয় ভূষণ তালুকদার, সুনামগঞ্জ জেলা বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক অ্যাড. হায়দার চৌধুরী লিটন ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাড. আকতারুজ্জামান সেলিম।
এলাকার হাট বাজারসহ সকল গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে সবচেয়ে বেশি ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন বর্তমান সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন, অ্যাড. রঞ্জিত সরকার ও সেলিম আহমদ এর পক্ষ থেকে লাগানো হয়েছে। এছাড়াও এলাকার বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যোগদানের মধ্য দিয়েও ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। এ মূহুর্তে এলাকায় সবচেয়ে বেশি আলোচিত জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি সাবেক ছাত্রনেতা সেলিম আহমেদ। এলাকাতে তিনি বিশিষ্ট দানবির হিসেবে পরিচিত। গেলো কয়েক বছরে এলাকাতে বেশ কয়েকটি কবরস্থান নির্মাণ, মসজিদ মাদ্রাসায় লক্ষ লক্ষ টাকা অনুদান প্রদানসহ অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা সহায়তা এবং দরিদ্র মানুষদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করে এলাকায় সাড়া ফেলেছেন। ২০২২ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় তিনি নিজস্ব অর্থায়নে প্রায় কোটি টাকার ত্রান বিতরণ করেন। এ সময় মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ত্রান সহায়তা বিতরণ করে তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছিলেন। এ ব্যাপারে সেলিম আহমদ প্রতিদিনের সংবাদকে জানান, তাহিরপুর উপজেলার মোদেরগাও গ্রামের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে আমার জন্ম। পারিবারিক ভাবেই আমরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। বুঝতে শেখার পর থেকেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে পথ চলার চেষ্টা করেছি। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য ছিলাম দীর্ঘদিন এবং বর্তমানে জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্বে আছি। মানুষকে সাহায্য সহযোগিতা করা এবং মানুষের বিপদে এগিয়ে আসাটা আমাদের পারিবারিক শিক্ষা। কারন ছোটবেলা থেকেই দেখে এসেছি যে কোন বিপদ আপদে এলাকাবাসীরা আমাদের বাড়িতে ছুটে আসতেন এবং আমাদের বাপ চাচারা তাদের এই সমস্যা সমাধান করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। পারিবারিক ভাবেই মানুষের পাশে থাকা শেখা। আওয়ামী লীগ ও ভোটের রাজনীতি রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। মানুষের বিপদে পাশে থাকাই নেশা আমাদের। আমার চাচা ছিলেন দুইবারের নির্বাচিত ইউনিয়ন চেয়ারম্যান, আমার বড় ভাই নিজাম উদ্দিনও বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি আমাদের ইউনিয়ন থেকে দুইবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে অনেক দিয়েছেন আর চাওয়ার কিছু নাই। যদি জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দেন তাহলে যত প্রতিদ্বন্দিতামূলক নির্বাচনই হোক, জয় নৌকারই হবে। এলাকার এবং জনগণের উন্নয়নে শতভাগ কাজ করবো ইনশাআল্লাহ।
সুনামগঞ্জ-সিলেট সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশ কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শামীমা আক্তার খানম বলেন, আমার সুনামগঞ্জ জেলা কৃষকলীগের নেতা কর্মীদেরকে সাথে নিয়ে দীর্ঘ দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে সুনামগঞ্জ-১ আসনের আপামর জনসাধারণের সুখে দুঃখে পাশে থাকার চেষ্টা করছি। গেল দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আমি দলীয় মনোনয়ন চেয়েছি।বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার মমতায় সংরক্ষিত নারী আসনে প্রতিনিধিত্ব করছি। আশা করছি আগামী জাতীয় নির্বাচনে এই আসনে আমাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাড. রঞ্জিত সরকার জানান, ছাত্রলীগের রাজনীতিতে হাতে খড়ি হয় স্কুল জীবনেই। পরবর্তীতে সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগকে নেতৃত্ব দিয়েছি সামনের সারি থেকে। স্বৈরচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় ছিলাম সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। নেতৃত্বগুণে হয়েছিলাম সিলেট জেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক কমিটির সদস্য। পরবর্তীতে সিলেট জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং পরে সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম আহবায়ক, পরবর্তীতে সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত আহবায়কের দায়িত্ব পালন করেছি। রাজনৈতিক জীবনে আমাকে সহ্য করতে হয়েছে অমানুষিক নির্যাতন। ১৯৮৯ সালে স্বৈরচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এই মামলায় জেলে ছিলাম দীর্ঘ ০১ বছর।
১৯৯৩ এবং ১৯৯৫ সালে বেগম জিয়া সরকারের সময় একই ভাবে আমাকে ছাত্রলীগের মিছিল থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায় পুলিশ। এই দুইবারে আমাকে কারাবরণ করতে হয় দীর্ঘ ০৭ মাস। এই দুইটি মামলায় আমাকে রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। ১৯৯৬ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার প্রহসনের নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায় চোখ প্রায় নষ্ট হয়ে যায়। তখন আমাদের মমতাময়ী নেত্রীর আর্থিক সহায়তায় ভারতের শংকর নেত্রালয়ে চিকিৎসা করে চোখের জ্যোতি ফিরে পাই। ২০০১ সালে জামাত-বিএনপি জোট সরকার গঠন করার পর, "অপারেশন ক্লিন হার্ট" নামক আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের দমনের যে মিশন জামাত-বিএনপি জোট সরকার শুরু করেছিলো, তখন আমাকে গ্রেফতার করা হয় স্বপরিবারে। পুরোটা ফ্যামিলির উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। সিলেটের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই ধরনের ঘটনা বিরল!
রাজনীতি করার কারণে আমার উপর মামলা হতে পারতো, কিন্তু পুরো পরিবারের বয়স্ক, নারী, শিশু সবাইকে গ্রেফতার করে নির্যাতনের নজির আর ২য়টি নাই। পরবর্তীতে এই সাজানো মামলায় জেলে ছিলাম দীর্ঘ ০৬ মাস। ২০০৩ সালে চারদলীয় জোট সরকারের মদদে সিলেট গুলশান কমিউনিটি সেন্টারে আওয়ামীলীগের নেতা-কর্মীদের উপর গ্রেনেড হামলা করা হয়। তখন ইব্রাহিম ভাই শহীদ হন। আহত হন আরো অনেকে। এই মামলায় চারদলীয় জোট সরকারের মদদপুষ্ট পুলিশ আমাকে সিলেট আদালত চত্তর থেকে গ্রেফতার করে এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমাকে দিয়ে জজ মিয়ার মতো একটি নাটক মঞ্চস্থ করার চেষ্টা চালায় পুলিশ বাহিনী। এই মামলায় সকল আইন ভেঙ্গে ১৭ দিন রিমান্ডে রেখে আমার উপর চালানো হয় অত্যাচারের স্টিম রোলার। এই মামলায় জেলে ছিলাম দীর্ঘ ০৪ মাস। তিনি আরো জানান, বন্যা, করোনায় মানুষের পাশে থেকেছি। গেল ১৫ বছর যাবৎ ঈদ-পুজোর আনন্দ ভাগাভাগি করছি নির্বাচনী এলাকার মানুষের সাথে। এবার প্রত্যেকটি এলাকায় নববর্ষ ও ঈদ শুভেচ্ছার ব্যানার-ফেস্টুন সাটানো হয়েছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন প্রচারসহ এলাকার নেতা-কর্মীদের সাথে নিয়ে শান্তি সমাবেশ করছি প্রতিটি এলাকায়। যদি জননেত্রী শেখ হাসিনা আমাকে মনোনয়ন দেন তাহলে জননেত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার মিশন বাস্তবায়নে কাজ করবো।
করুনা সিন্ধু চৌধুরী বাবুল বলেন, ৪০ বছর হয় পেশাদার রাজনৈতিক কর্মী। দল এবং এলাকার মানুষের বাইরে চিন্তা করার চেষ্টা করিনি।দলের দুর্দিনে সরে থাকার চেষ্টা করিনি। তিনভাই জেল খেটেছি। দলীয় মনোনয়নের চেষ্টা করছি গেল তিন জাতীয় নির্বাচন থেকেই। এবার আমি আশাবাদী।
ড. রফিকুল ইসলাম তালুকদার বললেন, এই আসনে সবচেয়ে বেশি দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশী সক্রিয় আছেন। সকলকে একমঞ্চে প্রচার চালানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তাতে জনগণের প্রার্থী বাছাইয়ে সহজ হবে।
বিনয় ভূষন তালুকদার বললেন, পোস্টার-ব্যানার কেবল নয়। এলাকায় যোগাযোগ ও যাওয়া আসার মধ্যেই আছি। আশা করছি দলীয় মনোনয়ন পাব এবার।
সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোয়াজ্জেম হোসেন রতন জানান, আমি হাওর এলাকার সংসদ সদস্য। আমার নির্বাচনী এলাকাগুলো হাওর দ্বারা বেষ্টিত। ভালো ফসল হওয়ায় এবার হাওর-বাসীর মনে আনন্দের ঢেউ উঠেছে। সরকারের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেবার চেষ্টা করছি প্রতিটি মানুষের কাছে। অন্যরাও দিচ্ছেন। সাধ্য থাকুক আর না থাকুক। স্বাদতো অনেকেরই আছে। পর পর তিনবার নেতৃ আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন এবং আশা করছি এবারও দিবেন। আমি মনোনয়ন পেলে হাওর এলাকার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখবো।