আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন আজ বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর)। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দাদার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন।
এবারের জন্মদিনে শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগ দিতে সেখানে যান প্রধানমন্ত্রী। তিনি সেখানে ঘরোয়া পরিবেশে জন্মদিন পালন করবেন বলে জানা গেছে। তবে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই বাংলাদেশে দিনটি উৎসবমুখর পরিবেশে নানা আয়োজন ও কর্মসূচির মধ্যদিয়ে উদযাপন করবে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।
শেখ হাসিনার ডাক নাম হাসু (হাচু)। পিতা বঙ্গবন্ধু আদর করে এই নামেই ডাকতেন তাকে। শেখ হাসিনার শৈশব-কৈশোর কেটেছে দাদা-দাদির কোলে-পিঠে মধুমতি নদীর তীরে টুঙ্গিপাড়ায়। তারা পাঁচ ভাই-বোন। অপর চার জন হচ্ছেন—শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা এবং শেখ রাসেল। ভাই-বোনদের মধ্যে শেখ হাসিনা ও রেহানা ছাড়া কেউই জীবিত নেই। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে পিতা বঙ্গবন্ধু এবং মাতা ফজিলাতুন নেছাসহ সবাই ঘাতকদের হাতে নিহত হন।
শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়ে পরিবারকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তখন পুরনো ঢাকার রজনী বোস লেনে ভাড়া বাসায় তারা ওঠেন।
বঙ্গবন্ধু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হলে সপরিবারে ৩ নম্বর মিন্টু রোডের বাসায় তারা বসবাস শুরু করেন। শেখ হাসিনাকে ঢাকা শহরে টিকাটুলির নারী শিক্ষা মন্দিরে (বর্তমানে শেরেবাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়) ভর্তি করা হয়। পরে তিনি ভর্তি হন আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই তিনি ১৯৬৫ সালে মাধ্যমিক, ১৯৬৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা কলেজ) থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ওই বছরেই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সে ভর্তি হন এবং ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
শেখ হাসিনা ইন্টারমিডিয়েট গার্লস কলেজে পড়ার সময় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সদস্য এবং রোকেয়া হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন এবং ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
পিতা বঙ্গবন্ধু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় কারাগারে থাকাকালে ১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানের করাচিতে নিয়ে যাওয়ার পর গোটা পরিবারকে ঢাকায় ভিন্ন এক বাড়িতে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। অবরুদ্ধ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই শেখ হাসিনা গৃহবন্দি অবস্থায় তার প্রথম সন্তান ‘জয়’-এর জন্ম হয়। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর কন্যাসন্তান পুতুলের জন্ম হয়।
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হবার আগে ছোট বোন শেখ রেহানাসহ শেখ হাসিনা ইউরোপ যান। সেখানে অবস্থানকালে তিনি সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর নিহত হবার খবর পান। তাৎক্ষণিকভাবে দেশে ফেরার কোনও পরিবেশ না থাকায় তিনি ইউরোপ ছেড়ে স্বামী-সন্তানসহ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন।
১৯৮১ সালের ১৩ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। আর ওই বছরেরই ১৭ মে দীর্ঘ ৬ বছরের প্রবাস জীবনের অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশে ফিরে আসেন তিনি।
১৯৮৬ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি তিনটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৯০ সালের ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনের পরে তিনি পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে এবং সে বছরের ২৩ জুন দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে বিশাল বিজয় অর্জন করে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তৃতীয়বারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ভোটে নির্বাচিত হয়ে চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার নেতৃত্বে অর্থনীতির প্রতিটি সূচকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বিশ্বের কাছে বাংলাদেশকে তিনি একটি রোল মডেল হিসেবে পরিচিত করেছেন। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনেও তিনি বিশ্বনেতাদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন। মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতায় পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা মুসলিমদের আশ্রয় দিয়ে সারা বিশ্বে হয়েছেন প্রশংসিত। বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের অন্তপ্রাণ শেখ হাসিনা লেখালেখিও করেন। তার লেখা এবং সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩০টিরও বেশি। প্রকাশিত অন্যতম বইগুলো হচ্ছে— শেখ মুজিব আমার পিতা, সাদা কালো, ওরা টোকাই কেন, বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম, দারিদ্র্য দূরীকরণ, আমাদের ছোট রাসেল সোনা, আমার স্বপ্ন আমার সংগ্রাম, সামরিকতন্ত্র বনাম গণতন্ত্র, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিপন্ন গণতন্ত্র, সহে না মানবতার অবমাননা, আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি, সবুজ মাঠ পেরিয়ে ইত্যাদি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা, আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এতে তিনি বলেছেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথ ধরেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গড়ে উঠবে উন্নত-সমৃদ্ধ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। জন্মদিনে তাকে (শেখ হাসিনা) প্রাণঢালা শুভেচ্ছা ও উষ্ণ অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও ১৪ দলীয় জোটের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেন, ‘আমরা যেমন বলি বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। তেমনই শেখ হাসিনার জন্ম না হলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণের কাজ জাতি চোখে দেখতো না। শেখ হাসিনার জন্মের সফলতা ও সার্থকতা কর্মের মধ্য দিয়ে।
দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শেখ হাসিনার জন্মদিন বাংলাদেশের জন্য একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। বঙ্গবন্ধু আমাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতার রোল মডেল। শেখ হাসিনা আমাদের উন্নয়ন এবং অর্জনের রোল মডেল। তিনি নিজে যা অর্জন করেছেন, তা নজিরবিহীন। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করেছেন। তার জন্মদিন পালন না করলে আমরা জাতির কাছে অকৃতজ্ঞ থেকে যাবো।’
কর্মসূচি
বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) কেন্দ্রীয়ভাবে বাদ জোহর জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। বাদ আসর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে ঈদে মিলাদুন্নবী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের উদ্যোগে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হবে। একই সাথে সকাল ৯টায় মেরুল বাড্ডাস্থ বৌদ্ধ মন্দিরে, বৌদ্ধ সম্প্রদায়, সকাল ৯টায় খ্রিস্টান অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (সিএবি) মিরপুর ব্যাপ্টিস্ট চার্চে এবং সকাল ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায় বিশেষ প্রার্থনা সভার আয়োজন করবে। এসব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।
এ ছাড়া শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে ৩টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ইঞ্জি. মোশাররফ হোসেন। শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) ঢাকাসহ সারাদেশে সকল সহযোগী সংগঠন আলোচনা সভা, আনন্দ র্যালি, শোভাযাত্রা ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীসহ দিবসটির তাৎপর্য অনুযায়ী বিভিন্ন উপযোগী কর্মসূচি পালন করবে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের গৃহীত কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আলোচনা সভা, আনন্দ র্যালি, শোভাযাত্রা, সারাদেশের সকল মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং সকল ধর্মীয় উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার জন্য দলের সকল সহযোগী সংগঠন, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সংস্থাগুলোর সকল স্তরের নেতাকর্মী, সমর্থক ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। একইসাথে আওয়ামী লীগের সকল জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন, ওয়ার্ডসহ সমস্ত শাখার নেতাদেরকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনুরূপ কর্মসূচি গ্রহণ করে দিবসটি পালন করার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।