মোঃ আতিকুর রহমান, সুনামগঞ্জ থেকে: সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর তীরবর্তী গ্রাম বিনোদপুর, পনিয়াখালি, কান্দাপাড়া, রতনপুর। হাওর এলাকার মাঝামাঝি অবস্থান হওয়ায় গ্রামগুলো খুবই অবহেলিত, নেই কোন উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা। অধিকাংশ মানুষই হাওর থেকে মাছ সংগ্রহ করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন। একদিকে নিম্নমানের জীবন ব্যবস্থা অপরদিকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে তাদের কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যৎ। প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় গ্রামগুলোর বহু সংখ্যক শিশু শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাড়ী থেকে বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেশি হওয়ায় শিশুরা স্কুলে যেতে চায় না বলে জানিয়েছেন অভিভাবকরা। ফলে এসব শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন অভিভাবকরা। তারা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন।
গ্রামবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, ৪টি গ্রামে প্রায় পাচশতাধিক পরিবারের বসবাস। পরিবারগুলোতে ৫-১০ বছর বয়সী শিশু রয়েছে প্রায় তিনশতাধিক। এলাকাটির পশ্চিম-উত্তরে চার কিলোমিটার দুরে বীরেন্দ্রনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পশ্চিমে টাঙ্গুয়ার হাওরের অপর পাড়ে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরবর্তী ইন্দ্রপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,পূর্ব দিকে এরালিয়াকোনা হাওরের অপর পাড়ে মন্দিয়াতা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পূর্ব-উত্তর দিকে ৫ কিলোমিটার দূরবর্তী রঙ্গাছড়া নদীর অপর পাড়ে সোনাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় অবস্থিত। গ্রামগুলো থেকে স্কুল গুলোর দূরত্ব বেশি হওয়ায় বহু সংখ্যক শিশু প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত রয়েছে বলে অভিভাবকরা জানান।
স্থানীয় ইউপি সদস্য ও এলাকাবাসী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বারবার ধরনা দিয়ে শুধু আশ্বাসই পেয়েছেন। বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এতে ওই চার গ্রামের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী দীর্ঘদিন ধরে দূরবর্তী বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করছে। দূরবর্তী এলাকায় এবং হাওর তীরবর্তী হওয়ায় বর্ষাকালে নৌকায় এবং হেমন্তকালে পায়ে হেটে যেতে হচ্ছে চার কিলোমিটার দূরবর্তী বীরেন্দ্রনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। যার দরুন অনেক শিক্ষার্থীই ঝরে পড়ছে। শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার অনীহা বাড়তে শুরু করেছে দিনের পর দিন। এতে অভিভাবকরা সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন রয়েছেন।
এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে বিনোদপুর গ্রামের এনামুল হক ২০০৪ সালের চৌঠা সেপ্টেম্বর একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য তেত্রিশ শতক জায়গা এনামপুর ও বিনোদপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামে সাফ কবলা করে দেন যার দলিল নাম্বার-৩৩৮০। পরবর্তীতে গ্রামবাসীর উদ্যোগে এখানে একটি অবকাঠামো নির্মাণ করে এনামপুর ও বিনোদপুর বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরন করা হয়। বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ২০০৫ সালের ১লা জানুয়ারি বিনোদপুর গ্রামের মোঃ সাজল হকের ছেলে শিক্ষানুরাগী জহিরুল ইসলাম নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে আরো তিনজন সহকারি শিক্ষিকা নিয়ে বিনা বেতনে এলাকার কোমলমতি শিশুদের পাঠদান শুরু করেন। এভাবে দুই বছর চলার পর গ্রামবাসীর উদ্যোগে একটি স্কুল পরিচালনা কমিটি গঠন করে ২৫/০৯/২০০৭ ইং সালে জহিরুল ইসলামকে প্রধান শিক্ষক করে তিনজন সহকারি শিক্ষিকা স্থায়ীভাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
২০১০ সালে এফআইভিডিবির সহযোগীতায় নেদারল্যান্ডস সরকারের আর্থিক অনুদানে ১২লক্ষ ৭২ হাজার তিনশত পাঁচ টাকা ব্যায়ে একটি স্কুল ভবন নির্মাণ করে দেওয়া হয়। ২০১২ সাল পর্যন্ত গ্রামগুলোর সর্বসাধারণের অর্থায়নে একজন শিক্ষককে নিয়মিত বেতন প্রদান করা হয়। প্রধান শিক্ষকসহ বাকি দুজন নিজ এলাকার কোমলমতি শিশুদের কথা বিবেচনা করে দীর্ঘ ৭ বছর এখানে বিনা বেতনে পাঠদান করেন। পরবর্তীতে শিক্ষকদের সংসারের অভাব অনটনের কারনে বিদ্যালয়টির কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৩ সালে সারাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ হওয়ার সময় প্রধান শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বিদ্যালয়টি সরকারীকরণের আশায় পুনরায় চালু করেন এবং স্কুলটির জাতীয়করণের জন্য ১৮/০৫/২০১৭ ইং তারিখে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে ফাইল জমা দেওয়া হয় যার ডাইরি নং-৪৪৭০ সিরিয়াল নং-৭৭। বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে কোন উপায়ন্তর না পেয়ে তিনি এলাকার লোকজনকে নিয়ে স্কুলটি জাতীয়করণের লক্ষ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন রতনের সহযোগিতা কামনা করেন। এ সময় সংসদ সদস্য এলাকার কোমলমতি শিশুদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে ২৬/০২/২০১৮ ইং তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর একটি ডিও লেটার প্রেরণ করেন যার ডিও নং প্রমকা/সুনাম-১/০১৩/০৭১৬/১৮ স্মারক নং প্রমকা/সসকা/০১৩/০৪৭/১৮। ডিও লেটারটিতে তিনি উল্লেখ করেন, সুনামগঞ্জ জেলাধীন তাহিরপুর উপজেলা সদর থেকে ২০ (বিশ) কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত এনামপুর ও বিনোদপুর নন রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি অত্র উপজেলার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। বিদ্যালয়টি ২০০৫ ইং তারিখে প্রতিষ্ঠিত হয়।
এনামপুর ও বিনোদপুর গ্রামের ০৪ (চার) কিলোমিটারের মধ্যে আর কোন বিদ্যালয় নেই। অত্র উপজেলা সুনামগঞ্জ জেলার বিখ্যাত হাওর অঞ্চল নামে খ্যাত। সেই অঞ্চলটি সারাদেশের তুলনায় শিক্ষায় অনগ্রসর। দেশের বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় সমূহকে জাতীয়করণ করবেন বলে ইতিমধ্যে বর্তমান সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাই অত্র উপজেলার শিক্ষায় সুবিধা বঞ্চিত গণ-মানুষের প্রাণের দাবী এনামপুর ও বিনোদপুর নন রেজিঃ বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করা হলে অত্র এলাকা শিক্ষা বৈষম্য থেকে মুক্ত হবে। অতএব, যেহেতু বিদ্যালয়টিতে প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো ও শিক্ষার্থী রয়েছে তাই সুষ্ঠুভাবে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা এবং শিক্ষার মান উন্নয়নের স্বার্থে উক্ত বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করার জন্য আপনার সুদৃষ্টি কামনায় সবিনয়ে বিনীতভাবে অনুরোধ করছি। কিন্তু তৃতীয় ধাপেও বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ না হওয়ায় পুনরায় বন্ধ হয়ে যায় বিদ্যালয়টি। প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় নিরক্ষরতা, শিশু শ্রম, বাড়ছে বলে মনে করছেন এলাকাবাসী।
গ্রামের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, তাদের গ্রামে বিদ্যালয়ের কোন কার্যক্রম নেই। এতে তারা কষ্ট করে পাশের বিদ্যালয়ে গিয়ে লেখা-পড়া করছে। আমাদের অনেক সহপাঠী দূরের স্কুলে যায়না আবার অনেকে লেখাপড়াও ছেড়ে দিয়েছে। আমরা আমাদের গ্রামে একটি বিদ্যালয় চাই। লেখাপড়া শিখে আমরা বড় হতে চাই।
স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি জাহাঙ্গির আলম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,শত বছরের পুরনো গ্রাম বিনোদপুর, পানিয়াখালি, কান্দাপাড়া। প্রজন্মের পর প্রজন্ম চলে যাচ্ছে কিন্তু এখনো পর্যন্ত একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়নি এলাকায়। মনের ইচ্ছা থাকা স্বত্বেও ভৌগুলিক অবস্থানের কারনে নিজেও বেশিদূর লেখাড়া করতে পারিনি। অনেক কষ্ট করে নৌকা বেয়ে ৪ কিলোমিটার দূরবর্তী বীরেন্দ্রনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রাইমারি পাশ করেছি । পরবর্তীতে নেত্রকোনায় গিয়ে নবম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে পড়ার কারনে আর লেখাপড়া করা হয়নি। নিজেদের পরবর্তী প্রজন্মও স্কুলের অভাবে লেখাপড়া করতে পারেনি। বেচে থাকাবস্থায় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় দেখে যেতে পারবো কিনা তাও জানিনা। আগামী প্রজন্মের উজ্জল ভবিষ্যতের জন্য এই স্কুলটির জাতীয়করণের জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাই।
স্কুলটির জমি দাতা এনামুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, ‘বয়স অনেক হলো। বৃদ্ধ হয়ে গেছি। নিজের জায়গা জমি কম তবুও গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ৩৩ শতক জমি দান করেছি। অনেক মানুষের দ্বারে-দ্বারে গেছি। তারা শুধু আশ্বাসই দিয়েছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি। মৃত্যুর আগে বিদ্যালয়টির জাতীয়করণ দেখে যেতে চাই।এ ব্যাপারে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সহযোগিতার অনুরোধ জানাই।
স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহজাহান খন্দকার বলেন, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় আমার ওয়ার্ডের ৪টি গ্রামের অনেক শিশু-কিশোর দূরে খুব কষ্ট করে লেখাপড়া করছে। অনেকে ঝরে পড়ছে। শিক্ষার অভাবে শিশু-কিশোর ও যুব সমাজ বিপথগামী হচ্ছে। বিদ্যালয়টি জাতীয়করণ হলে সু-শিক্ষা গ্রহণ করে একটি সুন্দর সমাজ গঠন করতে পারবে এলাকার শিশু-কিশোররা।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল খায়েরের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, যেসব জায়গায় স্কুল নেই সেসব জায়গায় স্কুল স্থাপনের জন্য এ বছরের এপ্রিল মাসে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনেকেই এ প্রকল্পের আওতায় আমাদের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দিয়েছেন। আমাদের টিম মাঠ পর্যায়ে তদন্ত করে যাচাই বাছাই করে যেসব জায়গায় স্কুলের বেশি প্রয়োজন সেসব জায়গায় স্কুল নির্মাণ করা হবে।