বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি, রাবি: প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত উত্তরবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ, বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও পুরাতন ৭৫৩ একরের সবুজ জমিটুকুর নাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। বিস্তর এ জমিনের আনাচে কানাচে রয়েছে সবুজের সমারোহ, সুউচ্চ গাছ, বিভিন্ন স্থাপনা, নানান ভাস্কর্য, দৃষ্টিনন্দন রাস্তা এবং বাহারি নামের অসংখ্য চত্বর। রাবি ক্যাম্পাসের বাঁকে বাঁকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চত্বরগুলোর সঙ্গে একদিকে যেমন মিশে রয়েছে ক্যাম্পাসিয়ানদের স্মৃতিকথা তেমনি ক্যাম্পাসের ভৌগোলিক পরিচিতির ও অন্যতম সহায়ক এই চত্বরগুলো।
ক্যাম্পাস জুড়ে শিক্ষার্থীদের প্রধান আড্ডাস্থল হলো এই চত্বরগুলো। এসব চত্বরের মধ্যে রয়েছে আবার অদ্ভুতসব নামের প্রস্ফুটন। ক্যাম্পাস জুড়ে মিশে থাকা এসব চত্বরই দিনের পর দিন শিক্ষার্থীদের আড্ডাস্থল থাকতে থাকতে এখন ক্যাম্পাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে নিজের অবস্থান জানান দিচ্ছে। এসব চত্বরই ক্যাম্পাসকে প্রাণ দেয়। তবে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকলেও আড্ডার বিরাম নেই এসব চত্বর নামের আড্ডা ঘরে। আর চত্বরগুলো ফাঁকা মানেই ক্যাম্পাস যেনো প্রাণহীন।
ইবলিস চত্বর:-
রাবি ক্যাম্পাসের সবচেয়ে পুরানো ও বহুল পরিচিত চত্বরের নাম ইবলিস চত্বর। ক্যাম্পাসের কাজলা গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকলে মমতাজ উদ্দীন কলা ভবনের পশ্চিম পাশের মাঠই ইবলিশ চত্বর। তবে নামকরণ নিয়ে আছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ বলছে, এই মাঠে বিভিন্ন খারাপ কাজ হয়। নেশা করা, মেয়েদের উত্যক্ত করা, অনেক রাত পর্যন্ত-আড্ডা দেয়া। সম্ভবত এ কারণেই এই চত্বরের নাম হয়েছে ‘ইবলিশ চত্বর’। তবে এর রয়েছে ভিন্ন ব্যাখ্যাও। অনেকে বলেন, এই চত্বরে আগে ছেলে-মেয়েদের একসাথে আড্ডা চলতো বলে ইসলামী ছাত্রশিবির এর নাম রেখেছেন ‘ইবলিস চত্বর’। তবে আরেকটা ভিন্নমতও পাওয়া যায়। স্বাধীনতার আগে কোন এক সময়ে এই চত্বরে ‘ইবলিশ’ নাটক করেছিলেন শিক্ষার্থীরা। আর সেখান থেকেই এই চত্বরের নামকরণ হয়েছে ইবলিশ চত্বর।
টুকিটাকি চত্বর:-
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রস্থল হিসেবেই টুকিটাকি চত্বর প্রতিষ্ঠিত। চারপাশের ভবন আর রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের আনাগোনায় সব সময়ই সরগরম থাকে এই চত্বরটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীর মূল ফটকের সামনেই এই চত্বরের অবস্থান। এখানে অবস্থিত 'টুকিটাকি জেনারেল স্টোরের' নাম অনুসারেই এই চত্বরের নামকরণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-সংগঠনের নেতাকর্মীদের আড্ডাস্থল হিসেবেই এটি বহুল পরিচিত। তবে একেবারে ক্যাম্পাসের মাঝে অবস্থান হওয়ার কারণে ক্যাম্পাস চালু থাকলে তো বটেই ছুটির দিনেও শিক্ষার্থীদের ভিড় থাকে এখানে।
ভকেট চত্বর:-
এই চত্বরের প্রতিষ্ঠাতা হলেন ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী শাহীন। ভকেট শব্দটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। ভকেট শব্দটি এসেছে ইংরেজি শব্দ Advocate থেকে Advocate এর Ad বাদ দিয়ে vocate করা হয়েছে। মূলত যারা বেশি কথা বলে, কিছুটা বখাটে, উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু ভবঘুরে নয় এবং নীতি কথায় বিশ্বাসী নয় কিন্তু যুক্তিবাদী তারা ভকেট হিসাবে পরিচিত। অর্থাৎ ভকেট হল বাচাল (কিছুটা ভবঘুরে ও হালকা বখাটে) এবং যুক্তিবাদীর সংমিশ্রণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজী ভবন ও মন্নুজান হলের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটাই 'ভকেট চত্বর!" এই চত্বরটায় একসময় ভকেটদের আড্ডা বসত কিন্তু বর্তমানে আর এখানে ভকেটদের আড্ডা জমে না। রাবিতে পড়েন অথচ ভকেট শব্দটি শুনেননি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে!!
চাচা চত্বর:-
বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ কলাভবনের মেইন গেটের সোজা দক্ষিণ রাস্তার ডানপাশে আমবাগানের ঘন ছায়ায় চাচা চত্বরটি অবস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে হাঁটার সময় খুব সহজেই চোখে পড়ে এটি। ‘চাচা ভাতিজার অবিরাম আড্ডা’- এ প্রতিপাদ্য ঘিরেই চাচা চত্বর প্রতিষ্ঠিত। তবে কে চাচা আর কে ভাতিজা এ ব্যাপারে কোন তথ্যই বলতে পারেন না কেউই। চাচা চত্বরে মূলত প্রেমি জুটিরাই বসেন। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরাই এটা প্রতিষ্ঠা করেছেন বলে শোনা যায়।
প্রেম চত্বর:-
মন্নুজান হলের সামনের এই চত্বরটির নাম ছিল প্রেম চত্বর। এর ওপর বর্তমানে চতুর্থ কলাভবন নির্মিত হয়েছে। এখানে প্রকাণ্ড আকৃতির আমগাছ ছিল এবং জুটিরা নিরাপদে বসে চুটিয়ে সকাল-বিকাল প্রেমের আলাপে ব্যস্ত- থাকত। আর এ কারণেই এই চত্বরের নাম প্রেম চত্বর হয়েছে। তবে এখন চতুর্থ কলাভবনের পেছনের দিকের সংকুচিত স্থানটিই প্রেম চত্বর নামে ডাকে শিক্ষার্থীরা। কারণ এখানে এখনো প্রেমিক জুটিদের মন দেয়া নেয়া চলে নিরাপদেই।
জোহা চত্বর:-
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই ১নং প্রশাসনিক ভবনের সামনে বৃহৎ আকারের একটি গোল চত্বর চোখে পড়বে। এটি জোহা চত্বর নামে পরিচিত। অনেকেই একে গোল চত্বর নামেও চিনে থাকে। এ চত্বরে শহীদ শামসুজ্জোহা স্যারের সমাধি অবস্থিত। সকাল থেকে রাত সবসময় ব্যস্ত থাকে এ চত্বরটি। ক্যাম্পাসের চত্বরগুলোর প্রাণকেন্দ্র হিসাবে জায়গা দখল করে আছে জোহা চত্বর।
ফোকলোর চত্বর:-
ইবলিশ চত্বরের একাংশকে ফোকলোর চত্বর বলে ধরা হয়। ১৯৯৮ সালে ফোকলোর আড্ডা কমিটি গঠিত হয়। পরের বছর ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির উদ্যোগে কৃষ্ণচূড়া এবং রাধাচূড়া গাছের চারা রোপনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে এ চত্বরের নাম রাখা হয় ফোকলোর চত্বর। মূলত ইবলিস নামটিকে বিলুপ্ত করার জন্য একই চত্বরে ফোকলোর আড্ডা কমিটি এ কাজটি করে। পরে ২০০৩ সালে ফোকলোর বিভাগে তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা এর সাইনবোর্ড ঝুলায়। এটি ক্যাম্পাসের অন্যতম পরিচিত একটি চত্বর।
গণযোগাযোগ চত্বর:-
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ বিভাগের নতুন নামকরণ হয়েছে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ। তবে তাতে পরিবর্তন হয়নি এই চত্বরের নাম। গণযোগাযোগ বিভাগের সামনের মেহগনি বাগানের ছায়ায় ঢাকা এই চত্বরটির অবস্থান।
বৈশাখি চত্বর:-
শহীদুল্লাহ কলাভবনের মেইন গেইটের সামনে বাম পাশে এ চত্বরের অবস্থান। বাংলা নববর্ষ ১৪১৩'র পহেলা বৈশাখে এটি প্রতিষ্ঠিত বলে এর নাম বৈশাখি চত্বর রাখা হয়। এ চত্বরের কোন কমিটি নেই, সবাই সক্রিয় সদস্য বলে বিবেচিত। প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে কয়েক জন হল- রোমেল, তন্ময়, নাহিদ সুজন প্রমুখ। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে এই চত্বরটি জমজমাট হয়ে ওঠে বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নানা আয়োজনের অনুষ্ঠানে।
মহাকবি কালিদাস প্রাঙ্গণ:-
সংস্কৃতের প্রাণপুরুষ মহাকবি ও সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এ চত্বরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ভাষা বিভাগের (সংস্কৃত) ২০০৫-০৬ শিক্ষা বর্ষের শিক্ষার্থীরা এই চত্বর প্রতিষ্ঠা করেন। মহাকবি কালিদাসের সাহিত্যকর্ম ও জীবনকর্ম নিয়ে এখানে নিয়মিত চর্চা হয়। মহাকবি কালিদাস চত্বরটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীনস্ কমপ্লেক্স ও ৪র্থ কলাভবনের মাঝামাঝি সোজা দক্ষিণ পাশের একটি আমগাছের বাঁধানো চারপাশটাই এই চত্বরের গণ্ডি।
দর্শন চত্বর.......
বিশ্ববিদ্যালয়ের মমতাজ উদ্দিন কলাভবনের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এ চত্বরটি। দর্শন বিভাগের ২০০৪-০৫ সেশনের শিক্ষার্থীরা এটির প্রতিষ্ঠাতা। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এখানে বসেই আড্ডা জমিয়ে তোলে দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। বিভাগের নামানুসারেই এ চত্বরের নামকরণ করা হয়েছে দর্শন চত্বর।
ময়েজ চত্বর:-
বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৯৯-২০০০ সেশনের বিভিন্ন বিভাগের ১৪ জন সদস্য মিলে ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠা করে ময়েজ চত্বর। সততা ও নিষ্ঠার শপথে আবদ্ধ মানুষের উপকার করার লক্ষে ওই শিক্ষার্থীদের প্রতিষ্ঠা করা সংগঠন ‘ময়েজ’ এর নামানুসারেই এই চত্বরের নামকরণ হয়েছে। ‘ময়েজ’ গ্রুপের আমৃত্যু ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আব্দুর রহমান ময়েজ এবং সেক্রেটারি এম ফজলে রাব্বি পাভেল। ময়েজ গ্রুপের নিজস্ব ভাষাও আছে। একসাথে বসলে তারা সে ভাষাতে কথা বলেন। ময়েজদের বেশিরভাগই ক্যাম্পাস ছেড়ে গেছেন। ময়েজ চত্বরের আগের অবস্থাও আর নেই। কিন্তু রবীন্দ্র ভবনের মেইন গেটের সামনে ডান পাশের এই চত্বরটির নাম এখনো ফেরে শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে।
রারু চত্বর:-
রাবিতে পড়ুয়া স্থানীয় শিক্ষার্থীদের সংগঠন রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশন অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি (রারু)। ময়েজ চত্বরের পূর্ব পাশে এই সংগঠনের জন্য নির্ধারিত চত্বর রারু চত্বর। বেশিরভাগ সময়ে এখানে স্থানীয় শিক্ষার্থীরা আড্ডা দিলেও সাধারণ শিক্ষার্থীদেরও পদচারণা রয়েছে এখানে।
রোকেয়া চত্বর:-
কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়াদেরই নয়, পার্শ্ববর্তী এলাকার ছেলে মেয়েদের কাছেও আগ্রহের বিষয় রোকেয়া চত্বর। ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের হৃদয়’ বলে পরিচিত পশ্চিম পাড়ায় রোকেয়া হল সংলগ্ন বটতলায় এটি অবস্থিত। হলের সামনের গোল চত্বরের নামানুসারেই লোকমুখে এটি রোকেয়া চত্বর হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। সন্ধ্যা বেলা এখানে ভিড় জমে উঠে বন্ধু-বান্ধব আর প্রেমিক জুটিদের আড্ডায়।
এছাড়াও ক্যাম্পাসে আরো রয়েছে শহিদ মিনার চত্বর, বুদ্ধিজীবী চত্বর, পাঠক ফোরাম চত্বর, জারজিস চত্বর, লিপু চত্বর, টিএসসিসি চত্বর, পলাশ চত্বর, ইতিহাস চত্বর, ক্যাম্পাস বাউলিয়ানা চত্বর, স্বজন চত্বর, বি.বি চত্বর, পাবনা চত্বর, নগর রাষ্ট্র, ইনফরমেশন অ্যান্ড নলেজ কর্নার, বাদামতলা চত্বর, সংস্কৃতায়ন অঞ্চল, সিএসই নেটওয়ার্ক, অস্থিরপুর, এমজিএম শাহরিয়ার মেমোরিয়াল হাউজ, পরিবহন মার্কেট, ফারসি চত্বরসহ আরো অনেক অনেক বাহারি নামের চত্বর।