মোঃ মিনহাজ আলম, ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধিঃ
ঠাকুরগাঁও সদরের কালিতলা আদিবাসী পল্লীর ৫ বছর বয়সী সবিতা, এবার সে তার একালার পাশের একটি স্কুলে ভর্তি হয়েছে প্রথম শ্রেণীতে। সবিতা নবজাতক থেকে আস্তে আস্তে বড় হচ্ছিল যে ভাষার আলিঙ্গনে, মায়ের সে ভাষাটিকে সে খুঁজে পায় না বিদ্যালয়ে। সেখানে প্রচলন নেই তার আদিবাসী ভাষাটির। কেউ কথাও বলে না তার প্রিয় সাদরি ভাষায়। চারপাশের সকলেই বাংলাভাষী। ফলে শিক্ষালাভ করতে এসে শিশু বয়সেই বাংলা ভাষাটি তার ওপর আরোপিত হয়। কিন্তু তার নিজস্ব মাতৃভাষা বর্ণ সবই আছে।
"ভাষা শুধু একটি জাতির পরিচয় নয় বরং প্রকাশমাধ্যমও। তাই শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষার ভূমিকাই প্রধান। কিন্তু এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে আদিবাসী শিশুদের জন্য নেই কোনো আদিবাসী ভাষার বই কিংবা আদিবাসী ভাষায় কথাবলা কোন শিক্ষক।
তাই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ভাষাগুলো আজ সংকটের মুখে। সময়ের পরিবর্তনে বিলুপ্তির পথে বাংলাদেশের আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় নতুন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে শত বছরের ঐতিহ্য তাদের এই মাতৃভাষা। এ নিয়ে বেশকিছু সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা উদ্যোগ নিলেও সেটি এখনও আলোর মুখ দেখেনি। ফলে আদিবাসী শিশুরা নিঃশব্দে বঞ্চিত হচ্ছে তাদের মাতৃভাষার দিগন্ত বিস্তারী আলো থেকে।
আদিবাসী পল্লীতে কথা হয় কিছু যুবকের সাথে তারা বলেন,"আমাদের সবার সাথে আমরা আমাদের ভাষায় কথা বলি, কিন্তু স্কুলে গেলে বা বাইরে সবার সাথে বাংলা ভাষাতে কথা বলতে হয়। কারণ তারা আমাদের ভাষা বুঝে না। এতে আমাদের ভাষার চর্চা কমে যাচ্ছে। সেই সাথে আমাদের স্কুলগুলোতে যদি আমাদের আদিবাসী ভাষায় পড়ানো হয় তাহলে আমরা আমাদের ভাষা চর্চা করতে পারবো সেই সাথে সকলেও আমাদের ভাষার সম্পর্কে জানতে পারবে।
আদিবাসীদের ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় আন্দলোন করে যাওয়া, বাংলাদেশ জাতীয় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ফেডারেশন ঠাকুরগাঁওয়ের, সাংগঠনিক সম্পাদক কবিরাজ মুর্মু বলেন, আমরা আদিবাসীরা সবসময় অবহেলিত আমাদের নিজস্ব ভাষা, বর্ণ সবাই আছে তবুও বাংলাদেশের সংবিধান এবং প্রাথমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের কোনো বইতেই আমাদের কোনো চিত্র বা ভাষা নেই। আমরা চাই আমাদের আদিবাসীদের ভাষা, চিত্র যাতে সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয় সেই সাথে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থাপন করা হয়।
ত্রিপুরা, রাখাইন, হাজং, বানাই, মণিপুরি, সাঁওতালি, মুরং, চাক, তঞ্চঙ্গ্যা, বম ইত্যাদিসহ বাংলাদেশের অনেক আদিবাসী ভাষা এখন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। এসব ভাষা রক্ষায় যদি উদ্যোগ নেওয়া না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভাষা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনেকরেন বিশ্লেষকরা।
আদিবাসী ভাষাগুলোর ইতিহাস সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। মণিপুরীদের মৈথয়ী ভাষার রয়েছে শত শত বছরের সাহিত্য ঐতিহ্য, সাঁওতালি ভাষায় রয়েছে সাহিত্য ও অভিধান, আর পশ্চিমবঙ্গ ও ঝাড়খন্ডে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখা হয় এ ভাষায়। মারমা ভাষায়ও মিয়ানমারে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে, আর বান্দরবানে জিরকুন সাহু নামে এক আদিবাসী বম ভাষায় অভিধান রচনা করেছেন। যেগুলো ভাষা সংরক্ষণে সহায়ক হতে পারে। তাই সমন্বিত উদ্যোগে সহজেই টিকে থাকতে পারে আদিবাসীদের মাতৃভাষাগুলো। তবুও প্রশ্ন থেকে যায় বাংলাভাষার দেশে আদিবাসী ভাষাগুলো সত্যিই রক্ষা পাবে তো?